বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘গণতন্ত্র নির্বাসিত নয়, সমাহিত। দুর্নীতি ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তোরনে দরকার জাতীয় ঐক্য। একই পথ, মত, ভাবনাও একই। আমরা আজ সবাই চাইছি ঐক্যবদ্ধতা। কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে বর্তমান অকল্যাণকর সরকারকে আগে সরাতে হবে। এ জন্য দরকার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন।’
বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে ‘জাতীয় বহুমুখী সংকট উদঘাটন ও নিরসন কল্পে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান বক্তার বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে গয়েশ্বর বলেন, ‘যত রকমের খারাপ বুদ্ধি, পরামর্শ বা খারাপ কাজ সরকার করছে… যা আমাদের জাতির জন্য দুঃখজনক। আলোচনা চলছে জাতীয় ঐক্যের। দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তবে একটা শ্রেণি হয়ত আসবে না, যারা উচ্ছিষ্টভোগী ও সুবিধাভোগী। তারা তো আসবে না। আবার একটা শ্রেণি ভালো থাকতে চায়, কিন্তু পারছে না… তারাও আসতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘নানাভাবেই দেশের অর্থনীতির আজকে খারাপ অবস্থা। গণতন্ত্র নির্বাসিত নয়, সমাহিত হয়েছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে। এমপি বানানোর জন্য মানুষ চাঁদা তুলে একজনকে মানুষ সহযোগিতা করছে। তার তিনিই কি না বছর পার হতে না হতে কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছে। এটা অনৈতিক আকাঙ্ক্ষার কারণে হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ভারতকে অপছন্দ করছি। কিন্তু তাদের দেশের নেতাদের কিছু গুনাবলি আছে। তারা কিন্তু তাদের দেশটাকে ভালোবাসছেন। নিজ দেশের জন্যই করার চেষ্টা করুন। এটা স্বীকার করতে হবে। আমরা নিজেদের ঐক্যবদ্ধতাকে জনগণের সামনে দৃশ্যমান করতে পারছি না। তবে আমাদের ভোট বর্জনের সিদ্ধান্তকে জনগণ সাধুবাদ জানিয়ে ভোট বর্জন করেছে।’
গোল টেবিল বৈঠকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সৃষ্টি হয়েছে কারণ রাষ্ট্র কীভাবে চলবে। তিনটি সরকার ব্যবস্থার কথা সব দার্শনিক বলেছেন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো কল্যাণমুখী রাষ্ট্র। নির্বাচন হবে ও সরকার গঠন হবে। কিন্তু কল্যাণকর রাষ্ট্রের ভিত্তি যদি স্থাপন করতে না পারি, তবে সেটি টিকবে না। জনরোষ, জনগণের আন্দোলনের মাধ্যমে গণবিরোধী সরকারকে সরাতে হবে। আমরা জানি, স্বৈরাচারী সরকার ছিল এরশাদ। এরপর কল্যাণকর রাষ্ট প্রতিষ্ঠার চেষ্টার মধ্যে আবার আসে ফ্যাসিস্ট সরকার। কিন্তু এ ধরনের সরকারকে খুবই নির্মমভাবে বিদায় নিতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘এ সরকার অভিনব কায়দায় ক্ষমতায় রয়েছে। এরকম কোনো নির্বাচন পৃথিবীর কোথাও কেউ দেখেছেন, শুনেছেন কিনা-আমার জানা নেই। একটা অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই অস্বাভাবিক সরকারকে বিদায় করা। যত বড় বড় বক্তৃতা করি না কেন, এই সরকারকে বিদায় নিতেই হবে।’
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা তোফাজ্জল হোসেন মিয়াজী বলেন, ‘ভোট ও ভাতের অধিকার নেই। মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হয়েছে কিনা ভোট আর ভাতের অধিকারে টের পাওয়া যায়। শিক্ষা সিলেবাসকে বিতর্কিত করা হয়েছে। আজকে শিক্ষার্থীদের সমকামিতার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যে কল্যাণকর রাষ্ট্রের প্রস্তাব আজ উত্থাপন করেছেন পীর সাহেব চরমোনাই তা ১৪০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠা করে উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন। একটি বার সেই কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দেখুন, সেখানে নাগরিকরা কীভাবে শান্তিতে থাকে।’
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, ‘বিদেশ সমর্থন নয়। নিজেদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জাতি নির্ভর চিন্তা করতে হবে। সাধারণ মানুষকে সাথে নিতে হবে। এবার ভোটই হয়নি। মানুষ ভোট প্রত্যাখান করেছে। সরকার পরিবর্তন করতে হলে জাতিকে জাগ্রত করতে হবে।’
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘পুলিশ হয়েছে পুলিশ লীগ। তারা মাঝেমধ্যে এসে ছবি তোলে, শোনে কে কী কথা বলছি। বাঘব-বোয়ালের পোয়া বারো। হাইকোর্ট বলে তদন্ত করো, আর আপিল বিভাগ বলে তদন্তই করা যাবে না। এখন ডলার নেই। ভোটের আগে তো চীন ও রাশিয়াও বলছে দেবে। এখন কেন ডলার সংকট বলুন দরবেশ সাহেব। সর্বোচ্চ মূল্যে মুদির কাছ থেকে বিদ্যুৎ নিচ্ছেন। রাষ্ট্র যখন এ অবস্থায় চলে যায়, আমাদের নামতে হবে। বিদ্রোহ করতে হবে।’
গণঅধিকার পরিষদের নবনির্বাচিত আহ্বায়ক কর্নেল (অব.) মিয়া মশিউজ্জামান বলেন, সবাই একমত… কল্যাণ রাষ্ট্র দরকার। প্রতিষ্ঠা করতে হলে বর্তমান স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করতে হবে। নয়তো সম্ভব না। ২০১৪ সাল থেকে এই সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত। বর্তমান অবৈধ সরকারকে না সরানো পর্যন্ত, চূড়ান্তভাবে ভারতের প্রভাবমুক্ত না করা পর্যন্ত কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। স্বৈরাচারী সরকার নিজের পতনের বীজ বুনে। তবে সেটির সময়কে ত্বরান্বিত আমাদেরই করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘জনআন্দোলন দরকার। কিন্তু লিডারশিপ বড় সমস্যা। সেটি কে দেবে? গত নির্বাচনে আমরা যারা অংশ নেইনি, তাদের মধ্যেই আলোচনা করতে হবে। রাস্তার আন্দোলন কখনো স্ট্রাকচারে হয় না। তবে নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলনের লিডারশিপ নির্বাচন করতে হবে।’
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, ‘আমাদের দেশ এমন এক জায়গায় এসেছে, তাতে সবাইকে এক মঞ্চে আসতে হবে। ওয়েলফেয়ার স্টেট জনগণ পায়নি। পররাষ্ট্র নীতিতে আমরা নতজানু।’
এলডিপির প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. নেয়ামুল বশির বলেন, ‘প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশ চলছে। এ দেশকে ধ্বংস করার জন্য সব ধরনের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে সরকার। বর্তমান সরকার দেশ ও জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছে না। করছে পার্শ্ববর্তী দেশের। আমাদের দরকার মোর্চা। যেখান থেকে যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারকে বিতাড়িত করতেই হবে। নইলে এই দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এই ধরনের সরকার অপ্রত্যাশিত, প্রত্যাখ্যাত। শাসন, বিচারবিহীন রাষ্ট্রকে সুগঠিত করতে জিহাদ ঘোষণা করতে হবে। এদেরকে (আওয়ামী লীগ) দিল্লি সরকারের কাছে প্রেরণ করতে হবে৷
রেজা কিবরিয়ার নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদের নিবনিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব ফারুক হাসান বলেন, জাতীয় বহুমুখী সংকট উদঘাটিত, চিহ্নিত, সুনির্দিষ্ট। এখন দরকার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। আমরা যদি মোকাবিলা করতে না পারি, তাহলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র মানচিত্রে থাকবে না। গত নির্বাচন জনগণের নির্বাচন ছিল না। একজন আওয়ামী লীগ প্রার্থী বর্ষীয়ান নেতা যখন বলেন, আমি ভারতের প্রার্থী, আওয়ামী লীগের প্রার্থী। তখন আমাদের সংকট পরিষ্কার, ভারতীয় আগ্রাসনে ৫৭ হাজার বর্গ মাইল আক্রান্ত। ভারতীয় আধিপত্যবাদ, আগ্রাসন বন্ধ করতে হলে তেল মারা, তোষামোদি বন্ধ করতে হবে। চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, তোষামোদি বন্ধ না হলে সম্ভব না। ভারতের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অনেক আগেই শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। একটা অন্ধ আনুগত্যের নাগরিক গড়ে তোলার জন্য সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়েছে। এই দেশকে বাঁচাতে হলে আধিপত্যবাদের আগ্রাসনকে মোকাবিলা করতে হবে।’